"ডোনাবেডিয়ানের ত্রয়ী" স্বাস্থ্য পরিষেবার মান নির্ণয়ের তিনটি স্তম্ভ
ডোনাবেডিয়ান বলতেন \cite{donabedian1988quality}, স্বাস্থ্য পরিষেবার মান নির্ধারণে তিনটি বিষয় বিবেচনা করে দেখতে হবে:
এক, কেমন ধরণের পরিকাঠামোয় চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে,
দুই: কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, ও
তিন: এই চিকিৎসা পরিষেবর নিট ফলাফল কি হল। এইএ তিনটি বিষয়ই সমান গুরুত্ব পাবে।
পরিকাঠামো বলতে বোঝানো হচ্ছে চিকিৎসা যেখানে দেওয়া হচ্ছে সেটি কেমন? হাসপাতালটি কোথায়, তাতে কি কি সুযোগ সুবিধা আছে, ডাক্তারবাবুর ডিগ্রি/পড়াশোনা, ডাক্তারবাবুর অভিজ্ঞতা, চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে কি কি ধরণের যন্ত্রপাতি রাখা, কারা চালাচ্ছে, গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা জুড়ে কি ধরণের রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা আছে, এই ধরণের বিষয় বিবেচনা করে দেখতে হবে। পরিকাঠামো আকারে ছোট হতে পারে, যেমন কারো নিজস্ব প্রাইভেট প্র্যাকটিস, অথবা বড় হতে পারে সরকারী স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার মত জটিল ও প্রকাণ্ড। শুধু আকার দিয়ে বিচার করলে চলবে না, ছোট আকারে ও সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে যে চিকিৎসা পাচ্ছেন বা করছেন তার উপযোগী যন্ত্রপাতি, মানুষজন, চিকিৎসক বা চিকিৎসা-কারী দলেন পেশাগত অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা -- এই ধরণের যা যা কাঠামোগত বিষয় হতে পারে, এ সমস্ত বিবেচ্য। অতএব যখন চিকিৎসার গুণমান বিচার করবেন, ভেবে দেখুন, যে চিকিৎসক বা চিকিৎসক দল চিকিৎসা করছেন, তাঁদের যথাযথ ডিগ্রি কি অভিজ্ঞতা আছে তো? যে জায়গাটিতে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে তার কাঠামোটি কি যথাযথ?
পরিষেবার প্রক্রিয়া বলতে বোঝানো হচ্ছে কি ভাবে পরিষেবা পাচ্ছেন বা কিভাবে, কি উপায়ে পরিষেবা প্রদান করা হচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও চিকিৎসা পরিষেবা হতে হবে সাক্ষ্যনির্ভর প্রমাণ-ভিত্তিক, এর অর্থ চিকিৎসক যে ধরণের চিকিৎসা করবেন তার বৈজ্ঞানিক , গবেষণা-প্রসূত ভিত্তি থাকতে হবে, কেবল পুঁথিগত বা তত্ত্বগত দিক থেকে চিন্তাভাবনা করে চিকিৎসা করলেই চলবে না; চিকিৎসক কত বিখ্যাত, তাতেও কিছু আসবে যাবে না। নব্বই দশকের শেষের দিক থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণ ভিত্তিক চিকিৎসার একটি বিপ্লব আসে \cite{djulbegovic2017progress} । এতে কেবলমাত্র শারীরবিদ্যা নয়, গবেষণাপ্রসূত কি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার ভিত্তিতে চিকিৎসা করার একটা জোয়ার আসে চিকিৎসক সমাজে। বিভিন্ন দেশে সরকার প্রমাণ ভিত্তিক চিকিৎসার সমাজে পূর্ণ প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন প্রমাণ ভিত্তিক চিকিৎসার নির্দেশিকা তৈরী করতে থাকেন। যে চিকিৎসা-ব্যবস্থা নিয়মিতভাবে তার সদব্যবহার করে, মনে করা হয় সে ব্যবস্থার মান অন্যদের তুলনায় উন্নত।
চিকিৎসা পরিষেবার নিট ফলাফলের মধ্যে থাকবে স্বাস্থ্যের উন্নতি, রুগীর রোগ সম্বন্ধে ধারণা ও জ্ঞানলাভ, চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে রুগী ও তাঁর পরিবার কতটা সন্তুষ্ট হলেন, এই ধরণের মাপযোক। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে চিকিৎসা পরিষেবার মান অনেকটাই চিকিৎসার পরে কি ফল হল তার ওপর নির্ভর করে। যে রুগী অস্ত্রোপচার করে "ভাল" হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন, তিনি চিকিৎসা পরিষেবার মান কে কম নম্বর দেবার আগে দুবার ভাববেন। এখানে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার ব্যাপারটি বিবেচনা করে দেখুন ।
ডোনাবেডিয়ান বলতেন চিকিৎসার প্রক্রিয়া ও ফলাফলের পারস্পরিক সম্বন্ধ জটিল। চিকিৎসা প্রক্রিয়া যথাযথ হল, তা সত্ত্বেও নানা কারণে রোগীর বিপর্যয় হতে পারে, যা ডাক্তার বা চিকিৎসক দল আশা করেছিলেন, তার উলটো হল, আবার এও দেখা গেছে, চিকিৎসা প্রক্রিয়া হয়ত প্রমাণ ভিত্তিক চিকিৎসা বা নির্দেশিকা মেনে হল না, তবু রুগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন, বা সুস্থ রইলেন।
এর ওপর রোগের জটিলতা বা বাড়াবাড়ির বিষয়টি নিয়েও বিবেচনা করে দেখুন। সরকারী হাসপাতালগুলোতে দেখবেন প্রায়শই জটিল ও নানারকম অন্যান্য রোগসম্বলিত রুগী ভর্তি হচ্ছেন, আবার ছোটখাট ও খুব নামীদামী বেসরকারী হাসপাতালে জটিল রোগীর ভর্তি সীমিত। কাজেই একই ফলের মাপকাঠিতে উভয় ধরণের চিকিৎসা-পরিষেবাকে বিচার করলে শুধু যদি ফলাফলের ভিত্তিতে বিচার করেন, দেখবেন যে বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবার মান সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসার মান থেকে অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট; অথচ রোগ-জটিলতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গভীরে বিশ্লেষণ করে দেখলে দেখা যাবে আসলে এদের মান একই রকম বা সরকারী চিকিৎসার মান অপেক্ষাকৃত ভাল \cite{engineer2016hospital}।
অস্যার্থ, চিকিৎসার কি ফল হল তাই দিয়েই শুধু যদি চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার একমাত্র মাপ হয়, তাহলে দুটো বিষয় গুলিয়ে যাবে।
এক, কিভাবে পরিষেবা প্রদান করা হচ্ছে তার পর্যালোচনা করা অসম্ভব, কারণ ফলাফল-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনায় প্রক্রিয়ার স্থান খুব সীমিত।
দুই, প্রক্রিয়া কি পরিকাঠামোর কি প্রভাব, তাও অজানাই থেকে যাবে, একটা পরিমাপেই সব কিছুর সরলীকৃত হয়ে যায়।
ডোনাবেডিয়ান বলতেন, পরিকাঠামো-প্রক্রিয়া-ফলাফল কেবল চিকিৎসার পরিষেবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, জনস্বাস্থ্যের মান বিচারের জন্য অন্য কিছু ভাবতে হবে।
বলতেন কোন চিকিৎসক গ্যারান্টি দিতে পারেন না যে চিকিৎসায় রুগী ভাল হয়ে যাবেন। চিকিৎসক শুধু এইটুকু নিশ্চিত করতে পারেন যে তিনি নিজে তাঁর চিকিৎসা পরিষেবায় ক্রমান্বয়ে উন্নতি ঘটাবেন; চিকিৎসার একটি নির্দিষ্ট গুণমান তিনি অর্জন করবেন। এইটুকুই একজন চিকিৎসক বা চিকিৎসা-পরিষেবা যাঁরা দেন, তাঁরা নিশ্চিত করতে পারেন, এর বেশী নয় ।
চিকিৎসকের তরফে গুণমান সুনিশ্চিত করা বা এই ব্যাপারটির ক্রমান্বয়ে উন্নতির প্রতিশ্রুতি পালন কোন উপায়ে সম্ভব?
প্রথমত, চিকিৎসক ও চিকিৎসা পরিমণ্ডল এমন হওয়া চাই যেখানে এই ক্রমান্বয়ে উন্নতিবিধান সম্ভব। দ্বিতীয়ত, রুগী ও চিকিৎসকের পারস্পরিক একটা যোগসূত্র নির্মিত হওয়া চাই। এমন যোগসূত্র, যেখানে তাঁরা পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস করেন। তৃতীয়ত, বিষয়টা কেবলমাত্র ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তারবাবু বা রোগীর নয়, গোটা চিকিৎসা পরিষেবার পরিমণ্ডলটিকে নিয়ে এখানে বিচার করতে হবে, ধরুন য মুহূর্ত থেকে রোগী হাসপাতাল বা চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য পরিষেবা-প্রদানকারীর কাছে আসছেন ও যে পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছেন তার তাবৎ সময়ে যেন একটি যথাযথ গুণমানের চিকিৎসা পরিষেবা তিনি পেতে পারেন, তা না হল এই বিশ্বাস জন্মাবে না। এই জায়গাটিতে রোগীর বাড়ির লোকেরও একটি ভূমিকা থেকে যায়। চতুর্থত, চিকিৎসকের এখানে তাঁর গুণমান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নিজের কাজকর্মের পর্যালোচনা করা, সেখান থেকে শেখার একটি ব্যাপার আছে। বারবার চিকিৎসক নিজের কাজের মূল্যায়ণ নিজে করবেন, নিজের ও অন্যান্য প্র্যাকটিস থেকে ধরুন তথ্য গ্রহণ করবেন, তাকে বিশ্লেষণ করবেন, দেখবেন যে কি করে আরো ভাল করে পরিষেবা দিতে পারেন। এটা স্বল্পমেয়াদী ব্যাপার নয়, এতে ক্রমাগত মানোন্নয়নের একটা জায়গা আছে। ডোনাবেডিয়ান বলতেন যে ডাক্তারের পক্ষে মানোন্নয়নের একটি উপায় পরস্পরের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে, এক চিকিৎসক অপরকে প্রতিনিয়ত দেখবেন, একে অপরের কাছ থেকে শিখে, যোগাযোগ রক্ষা করে তাঁরা তাঁদের গুণগত মান বাড়াবেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের আদিকাল থেকে এভাবেই চিকিৎসকেরা নিজেদের গুণমান বৃদ্ধি করে এসেছেন । যে হাসপাতালে হবু ও ট্রেনি ডাক্তারদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত থাকে, বা যেখানে নিয়মিত ভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের চর্চা করা হয়, সেইসব হাসপাতালে চিকিৎসা-পরিষেবার মানও উন্নত হবে, এটা ডোনাবেডিয়ানের নিদান বলতে পারেন \cite{donabedian1988quality}।
রোগী কেন্দ্রিক চিকিৎসা
আমরা এ পর্যন্ত চিকিৎসা-পরিষেবার মানের একটি দিক পর্যালোচনা করেছি, আমরা দেখেছি যে, চিকিৎসা পরিষেবার তিনটি "স্তম্ভ" -- ডাক্তার/চিকিৎসক/পরিষেবা-প্রদায়ী, রুগী, ও যিনি চিকিৎসা পরিষেবায় অর্থ যোগান দেন। ডাক্তার বা যিনি বা যাঁরা অর্থের যোগান দিচ্ছেন (সরকার, বা ধরুন স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানী), তাঁদের তরফে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান নিয়ন্ত্রণ বা মান নিরূপণের একটি দিক আমরা আলোচনা করেছি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামো বলুন কি ডোনাবেডিয়ানের নিদান বলুন তার কোনটাতেই কিন্তু যে মানুষগুলোর ওপর চিকিৎসা করা হচ্ছে বা হবে তাদের কোন উল্লেখ নেই। অথচ রোগীরাই যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থার কেন্দ্রে! ডোনাবেডিয়ান ডাক্তারদের কথা বলেন, পরিকাঠামো চিকিৎসার কথা বলেন। এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সে তুলনায় রোগীদের পরিপ্রেক্ষিত অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত ।
আজ একবিংশ শতকে চিকিৎসক রোগী ও অর্থদাতার নতুন সমীকরণ তৈরী হচ্ছে, তথ্যের ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে, এবং সেই প্রসার চিকিৎসা-বিজ্ঞান, চিকিৎসা পরিষেবা ও চিকিৎসক রোগীর পারস্পরিক সম্বন্ধকে প্রভাবিত করেছে। এখন বিভিন্ন রোগীরা ইন্টারনেটে মিলিত হতে পারেন, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন, এমনকি নিজেদের অসুখ নিয়ে গবেষণা অবধি শুরু করেছেন \cite{frost2008social}।